নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গত ৪ দশক অতিক্রম করে এখন বিশেষ প্রতিযোগতায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করার পর্যায়ে। শিল্পের এই অগ্রগতির সাথে তাল রেখে আমরা যদি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত পর্যায়ে তুলে আনতে পারি, তাহলে কারো আপত্তি থাকার কথা না। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করা গেলে শিল্পের অস্থিরতা কমে আসবে; টেকসই শিল্প ব্যবস্থাপনাও গড়ে উঠবে। পোষাক শিল্পখাতে বর্তমান পর্যায়ে ৪০ লক্ষ শ্রমিক জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এ শিল্পে কর্মরত। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপাই নেই- ৪০ বছর এ শিল্পে মালিকদের অতি-মুনাফার কারণে তাদের পরিবারের দেশে-বিদেশে অর্জিত ও পাচারকৃত সম্পদ এবং এতো অতি অভিজাত জীবনযাপন এ শিল্প মালিকেরা চিন্তাও করতে পারেনি। অথচ এদের ইমালিকানাধীন শিল্পের শ্রমিকেরা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অতিদরিদ্র জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে মালিকদের অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে ভোগ-বিলাস ও প্রাচুর্য্য, অন্যদিকে অভাবঅনটন, পেট ভরে না খেতে পাওয়া, সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন সমস্যা, এ যেন প্রদীপের নিচে ঘোর অন্ধকার। গার্মেন্টস শিল্পের সংকটের প্রধান সমস্যা এখানেই। শ্রম আইন প্রতিপালন না করা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে রাখা, উৎপাদনের নামে মাত্রাতিরিক্ত টার্গেট দেয়া, অনিরাপদ কর্ম-পরিবেশ, আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে প্রাণহানী, কম মজুরি, বিলম্ব মজুরি, এক কথায় সভ্য সমাজে এর চেয়ে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাপনা পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে জানা নাই।
বিকেএমইএ-বিজিএমইএ এই বৈষম্যগুলো দূরীকরণে সভা-সেমিনার ব্যতিত বাস্তবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজিএমইএ বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে
মালিক-শ্রমিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন নীতিমালা প্রয়োগে করছে বলে আমাদেও জনা নেই।
বরং বৈষম্য নানাভাবে আরও বেড়েই চলেছে।
চীন-ভারত, এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। মালয়শিয়ায় ১ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের নিম্মতম মজুরি ৪৭,০০০/- টাকা আর বাংলাদেশে তা মাত্র ১২,৫০০/- টাকা। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসন পতনের পর স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকদের মধ্যেও বৈষম্যমুক্ত কর্ম-পরিবেশের আকাংখা জেগে উঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মালিকগণ সবসময় যে যুক্তি দেয় এবারও একই যুক্তি দিচ্ছে ব্যবসা খারাপ, মজুরি বাড়ানো যাবে না।
বিশেষভাবে গত ১৬ বছরে শ্রমিকদের মধ্যে পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভের কারণে অধিকার আদায়ের বৈধ পন্থার
সুযোগ না থাকায় আজ আশুলিয়া, কাল সাভারে, পরশু গাজীপুরে দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে পড়ছে। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে সারা দেশে শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শ্রম মন্ত্রনালয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ত্রিপক্ষীয় ১৮ দফা চুক্তি হয়, কিন্তু নারায়ণগঞ্জে বিকেএমইএ এখনো শ্রমিকদের এই ১৮ দফা বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শ্রমিকদের দাবিগুলোকে অবহেলার চোখে দেয়া হচ্ছে।
এমনি একটি ঘটনা ছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লা-বিসিকে তখন শ্রমিকদের সাথে নব্য দাসের মতোই আচরণ করা হতো।
অভাব অনটনের কারনে গ্রাম অঞ্চল থেকে ছুটে আসতো গার্মেন্টস কারখানায় চাকুরীর জন্য। এই সুযোগ ব্যবহার করে মুনাফা লোভী মালিকেরা রাতা-রাতি বাড়ি, গাড়ি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইনের কিছুই মান্য করতো না। এখন মালিকেরা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক ফেডারেশন করলে তাদের চাকরি থেকে ছাটাই করে দিত। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে, বঞ্চিত শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো আর কেউ থাকে না। সময় মতো বেতন না দিয়ে ঘুরানো, ছাঁটাই, সাপ্তাহিক ছুটি না দেওয়া, ১ দিন এবসেন্ট করলে ৩ দিনের হাজিরা কেটে দেয়া, সবচেয়ে বড় ব্যপার ছিল কর্মদিবস ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা। দীর্ঘদিন যাবৎ গার্মেন্টস মালিকদের অমানবিক শোষণের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভ‚ত হয়ে চরম আকার ধারণ করেছিল। এছাড়াও ঐ সময়ে ফতুল্লার পলমল গার্মেন্টস, বিসিকের ফকির এ্যাপারেলস, সামস রেডিওয়্যার, তামান্না গার্মেন্টস, জি,আর, ফ্যাশনসহ বহু কারখানায় শ্রমিকেরা আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ করে নিজেদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা নিজেরাই আন্দোলন করে আসছিল। ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস, ওভার টাইমের মজুরি সহ ১৮ দফা দাবিতে ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীর প্যানটেক্স ড্রেস লি: গার্মেন্টস এর গেটের সামনে শিপমেন্ট আটকে দিয়ে একটানা ৩ দিন যাবৎ শ্রমিকেরা অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিল। ২রা নভেম্বর ২০০৩ এর রাতে নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন বিসিকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে; হঠাৎ সেখানে ৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে মালিকের শিপমেন্ট খালাস করার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠে। এজন্য তারা আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে একাধিকবার বৈঠকের নামে নানা প্রকার মিথ্যা আশ্বাস দিতে থাকে। অতীতে মালিকদের আশ্বাসের নামে ধোঁকাবাজির অভিজ্ঞতা এবং মালিকদের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা সে দিন আমার উপস্থিতি ছাড়া মালিক ও প্রশাসনের সাথে কোন বৈঠক করতে রাজি হয় না। এ কারনে সমস্যা সমাধানের জন্য উপস্থিত প্রশাসনের অনুরোধে আমি রাতেই বিসিকে যাই। ঐ সময়ে বিসিকের শত-শত কারখানায় শ্রমিকদের আন্দোলনের উত্তাপ ক্রমশঃ বেড়েই চলছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনমুখী এই টগবগে অবস্থা প্যানটেক্স গার্মেন্টস মালিক পক্ষ কখনোই গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এমতাবস্থায় ২রা নভেম্বর, ২০০৩ইং তারিখে মালিক দাবি না মেনে তালবাহানা করার কারণে শ্রমিকরা শিপমেন্ট আটকে দিয়ে কারখানা ঘেরাও করে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
শ্রমিকরা ৩ দিন/৩ রাত একটানা কারখানা ঘেরাও করে গার্মেন্টসের গেটের সামনে রাস্তায় বসে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
ঐদিন ভোর-সোয়া ৫ টার দিকে পুলিশ আমাকে বিসিক থেকে আটক করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়।
সকাল পৌনে ৬টায়, বন্দী অবস্থায় থানার ওয়্যারলেস সেটে বিসিকে শত-শত রাইফেলের গুলির শব্দ
শুনতে পাই। এ সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় প্যানটেক্স গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমজাদ হোসেন
কামাল এবং গুলিবিদ্ধ সুমি আক্তারকে ঢাকা মেডিকেল জরুরি বিভাগে পাঠানো হয়। আহত শত-শত
শ্রমিককে ভ্যানগাড়ি করে বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা স্থানীয় সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। সকাল ৭টার দিকে কারখানামুখী ৫০/৬০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর হাজার-হাজার রাউন্ড গুলির শব্দে আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠে। শ্রমিকের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, শ্রমিক হত্যা এবং বিনা কারণে আমাকে থানায় আটক করার সংবাদ বিসিকসহ পার্শ্ববর্তী সকল গার্মেন্টস কারখানায় দাবানলের
আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশি অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিক বসতির আশে পাশের বাসাবাড়ি, বিক্ষুদ্ধএলাকাবাসী হঠাৎ বাঁধ ভাঙা প্লাবনের মতো রাস্তায় ব্যাপক প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলে। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন আগ্নেয়গীরির মতো তীব্র গতিতে পুরো শহরে শ্রমিক বিস্ফোরণ ঘটে। শহরের চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। একটানা ১০/১৫ দিন নারায়নগঞ্জ প্রশাসনের অত্যাচারের খড়গ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে পড়ে । রাজপথ দখল করে নেয় বিপ্লবী শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে শিল্প এলাকা পঞ্চবটি শাসনগাঁও, কাশিপুর, জামতলা, ফতুল্লা, বিসিকের ৫০/৬০ হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক সকল পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে বীরদর্পে ফতুল্লা থানা থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য থানা ঘেরাও করে ফেলে।
৬ ডিসেম্বর ২০০৩ইং তারিখে বিকেএমইএ কার্যালয়ে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিসহ শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস মেনে নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। গার্মেন্টস সেক্টরে মালিকেরা যে নব্যদাস ব্যবস্থা কায়েম করেছে-৩রা নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অভ্যুত্থান হলো তার একটি আনুষ্ঠানিক জবাব মাত্র।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মালিকগন শ্রমিকদের মূল সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষভাবে মিল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন,শ্রম আইন বাস্তবায়ন এবং প্রত্যেক কারখানায় শ্রমিকদের জন্য স্বল্প মূল্যে স্থায়ীভাবে রেশনিং এর ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
শ্রমিকেরা খাদ্য নিরাপত্তা পেলে পরিস্থিতি অনেকাংশেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শিল্পের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেলে বায়ারদের অর্ডারও বৃদ্ধি পাবে।