মানুষের শরীরে শারীরিক বিপাকের ফলে যে বর্জ্য তৈরি হয়, তা শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে কিডনি। যখন শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না তখন শরীরে টক্সিন জমা হয়। কিডনি ড্যামেজের লক্ষণগুলো এত সূক্ষ্ণ যে, প্রাথমিকভাবে তা বোঝাই যায় না।
দেশে দিন দিন কিডনি রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশে গত এক বছরের ব্যবধানে কিডনি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর এই রোগীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১ সালের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার রোগী। ২০২২ সালে এই রোগী ভর্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ হাজারেও বেশি। আবার মৃত্যুহারও বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০২১ সালে মারা গেছেন ৫৪১ জন, ২০২২ এ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০২৭।
কিডনি রোগের লক্ষণ
কারও যদি কিডনি রোগের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা যায় তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হোন। কারণ কিডনি রোগের উপসর্গগুলোর সাথে অন্য স্বাস্থ্য সমস্যার উপসর্গের মিল আছে। আসুন জেনে নেই কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সম্বন্ধে।
১. ঘন ঘন প্রস্রাব করা
যদি আপনার প্রায়ই মূত্রত্যাগের প্রয়োজন হয় বিশেষ করে রাতের বেলায় তাহলে এটা কিডনি রোগের লক্ষণ। যখন কিডনির ছাঁকনিগুলো নষ্ট হয়ে যায় তখন প্রস্রাবের বেগ বৃদ্ধি পায়। ঘন ঘন মূত্রত্যাগ ইউরিন ইনফেকশনেরও লক্ষণ হতে পারে, পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্লেন্ড বড় হয়ে গেলেও এই উপসর্গ দেখা দেয়।
২. ক্লান্তি অনুভব করা
কিডনির কর্মক্ষমতা যখন মারাত্মকভাবে কমে যায় তখন রক্তে অপদ্রব্য হিসেবে টক্সিন উৎপন্ন হয়। ফলে আপনি দুর্বল ও ক্লান্ত অনুভব করেন এবং কোনো বিষয়ে মনোযোগ দেয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আরেকটা জটিলতা দেখা দিতে পারে, আর তা হচ্ছে এনেমিয়া। রক্তস্বল্পতার কারণেও দুর্বলতা বা অবসাদ গ্রস্থতার সমস্যা হতে পারে।
৩. ঘুমের সমস্যা হওয়া
যখন কিডনি রক্ত পরিশোধন করতে অপারগ হয় তখন রক্তের টক্সিন প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হতে পারে না বলে রক্তেই থেকে যায়। যার কারণে ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হয়। অবেসিটি বা স্থূলতার সাথে ক্রনিক কিডনি ডিজিজের যোগসূত্র আছে এবং নিদ্রাহীনতা ক্রনিক কিডনি ডিজিজের একটি সাধারণ উপসর্গ।
৪. ক্ষুধা কমে গেলে
এটা খুবই সাধারণ সমস্যা কিন্তু শরীরে টক্সিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার ফলস্বরূপ ক্ষুধা কমে যায়।
৫. ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
সুস্থ কিডনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত তরল বের করে দেয়, লাল রক্ত কণিকা তৈরি করে, হাড়কে শক্তিশালী করে এবং খনিজ লবণের ভারসাম্য রক্ষা করে। শুষ্ক ও ফেটে যাওয়া ত্বক খনিজ ও হাড়ের অসুখের জন্যও হতে পারে যা অ্যাডভান্স কিডনি রোগের সহগামী হিসেবে থাকতে পারে যখন কিডনি রক্তের পুষ্টি উপাদান ও খনিজ লবণের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না।
৬. প্রস্রাবের সাথে রক্ত গেলে
সুস্থ কিডনি সাধারণত ব্লাড সেলগুলোকে শরীরের ভেতরে রেখে রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ মূত্র হিসেবে বের করে দেয়। যখন কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন ব্লাড সেল বের হতে শুরু করে। প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়ার এই লক্ষণটি কিডনি রোগের সাথে সাথে টিউমার, কিডনি পাথর বা ইনফেকশনেরও ইঙ্গিত হতে পারে।
৭. প্রস্রাবে বেশি ফেনা হলে
প্রস্রাবে অনেক বেশি ফেনা দেখা দিলে বুঝতে হবে যে, প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন যাচ্ছে। ডিমের সাদা অংশ ফাটানো হলে যেমন ফেনা বা বাবেল হয় প্রস্রাবের এই বুদবুদও ঠিক সেই রকম। প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নামক প্রোটিনের উপস্থিতির জন্যই এমন হয়। কিডনির ফিল্টার ড্যামেজ হয়ে গেলে প্রোটিন লিক হয়ে প্রস্রাবের সাথে বের হয় বলে প্রস্রাবে ফেনা দেখা দেয়।
৮. পায়ের গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া
কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে পা এবং গোড়ালি ফুলে যায়। পায়ের নিচের অংশ ফুলে যাওয়া হার্ট, লিভার এবং পায়ের শিরার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।
৯. চোখের চারপাশে ফুলে গেলে
যখন কিডনি অনেক বেশি লিক করে তখন প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায় বলে চোখের চারপাশে ফুলে যায়।
১০. মাংসপেশিতে খিঁচুনি হলে
কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হলে শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা এবং মাংসপেশিতে খিল লাগার সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা কমে গেলেও মাংসপেশিতে খিল লাগার সমস্যা দেখা দেয়।
১১. বমি বমি ভাব
কিডনিতে সমস্যা হলে বমি বমি ভাব দেখায়। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। অনেক সময় বমিও হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, সব সময় ঠাণ্ডা অনুভব করা, মাথা ঘোরা, কোমর ও পায়ে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি উপসর্গগুলোও দেখা দিতে পারে।
দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা যে কারণে বাড়ছে
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট বলছে, দেশজুড়ে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, বিশেষ করে খাদ্যচক্রে সীসা, পারদ, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতু ঢুকে পড়া, ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার, ধূমপান, সেইসাথে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক সেবনের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলছে।
প্রতিবছর রোগী বাড়লেও সে হারে সেবার পরিধি সেভাবে বাড়ছে না। সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা। কিডনি চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসা নিতে পারেন না।
কারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে ?
কিডনি শরীরে ফিল্টারের মতো কাজ করে যা, শরীরের দূষিত ও ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়। কিন্তু কিডনি সেই কাজটি করতে ব্যর্থ হলে সেটি প্রতিস্থাপন করতে হয়, না হলে ডায়ালিসিস করাতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি নিয়ামক হচ্ছে- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্লোবিউলিন বা কিডনির প্রদাহজনিত রোগ।
তার বলছেন, যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাদের প্রস্রাবের সাথে অ্যালবুমিন যেতে যেতে কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। কায়িক শ্রম কমে যাওয়া, স্থূলতা বাড়া, ইত্যাদি কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে কিডনি রোগীও বাড়ছে।
এ ছাড়াও অনেকের হঠাৎ ডায়রিয়ার কারণে পানিশূন্যতা, প্রচুর রক্তপাত, ওষুধ খাওয়ার কারণে, হঠাৎ কোনো কারণে প্রস্রাবের নালি বাধাগ্রস্ত হলে আকস্মিক কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনি রোগ প্রতিরোধে পরামর্শ
কিডনি রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসে নজর দেয়ার পাশাপাশি প্রস্রাবে সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোনো ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া যাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী যাদের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে, তাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৭৫ বছরের পরে এই ঝুঁকি আরও বাড়ে। তাই এই বয়সীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।